পপগুরু, স্যালমন মাছ ও সোনালি জুসের গল্প
- June 05, 2021
- by
- tanvirtareq

তানভীর তারেক
একুশ বছর আগের কথা!
বেনসন এন্ড হেজেস স্টার সার্চ এর ফিনালে। শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেন। প্রথম আলো এবং আনন্দভুবনের দুটোতেই তখন দুই হাত পায়ে লিখি।
একদিকে কবির বকুল ভাইয়ের এসাইনমেন্ট। অন্যদিকে আনন্দভুবনের নজরুল ভাইয়ের এসাইনমেন্ট। আর কারো এসাইনমেন্ট না থাকলেও এসব কনসার্টে আমি পড়ে থাকতাম। কারন স্টার সার্চের একেবারে শুরু থেকে লেপ্টে পড়ে আছি আমি তখন। আনুশে, দীপ্ত, মেহরীনরা, ভাইকিংসের তন্ময় তখনও তারকা হয়নি। কিন্তু গানের প্যাটার্ন দেখে বুঝতে পারছি এরা সব একেকটা বারুদ।
সেই রকগান শোনার নেশাতেই গ্রান্ড ফিনালেতে যখন শেরাটন উইন্টার গার্ডেনে ধার্য করা হলো। রওনা দিলাম। কিন্তু এন্ট্রি কার্ড নিতে ভুলে গেছি। সেব্যপারে টেনশনও নেই..
কারণ শহরটা তখন আমার। শহরের আইয়ুব বাচ্চু আমার, হামিন আহমেদ, মাকসুদ ভাই সবাই আমার। আমার কইলজার বড় ভাই এগুলো। আমার আত্মীয়স্বজন বলতে মনে হতো এরাই। আমিও তাদের। দিনরাত এদের সাথেই।
প্রথম আলো আনন্দভুবনে দুই জায়গায় প্রদায়ক হিসেবে কাজ করি। বাসাবো , রামপুরায় দুইটা টিউশনি করি আর সাউন্ডটেকে কেবল যাতায়াত শুরু করেছি। প্রচুর ব্যস্ত আমি তখনও..
যাই হোক, আমি টিকিট ছাড়াই ঢুকতে গেছি যখন। চেকার ইভেন্টের পোলাপান আটকাইলো। ওপারে একটু দূরে সম্ভবত দাঁড়িয়ে ছিলেন ডিজেপ্রো’র তানিম ভাই। তখন টাক মাথায় একেবারে জো স্যাট্রিয়ানির ভাব ধরে ঘোরাফিরা করেন তানিম ভাই। দেশের বিশাল সাউন্ড কোম্পানি তার। তানিম ভাই আমাকে চিনতেন। হাত ইশারায় বাউন্সার ভেদ করে তানিম ভাইয়ের সাথে আই কন্টাক্ট করার চেষ্টায় আমি, যাতে ঢুকতে পারি। কিন্তু কোনোভাবেই তানিম ভাই আমাকে খেয়াল করছেন না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
এদিকে প্রদায়ক বলে কোনো অফিসই তো আমাকে তাদের আইডি কার্ড দেয়নি। তাই মুখে মুখে বলছি যে আমি সাংবাদিক। কিন্তু চেকার ছোকরারা বিশ্বাস করতে চাইছে না।
হঠাৎ লম্বা একটা হাত আমাকে খপ করে ধরে বললো,
এই তানভীর এখানে কী করস? বলেই বাউন্সার আর টিকেট চেকারদের বলতে লাগল,
ওরে আটকাইছস তোরা। আর কাম পাশ না। তোগো এই কনসার্ট বন্ধ কইরা দিবো। জানস এই পুচকাডা কে?
ইয়া মোটা গাটা শরীরগুলো তখন আমার লিকলিকে বেঁটে খাটো শরীরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওরা তখন ভীষণ বিরক্ত। এত বড় মাপের মানুষ আমাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে দেখে ওদের যেন সহ্যই হচ্ছিল না!
সেই লম্বা বলিষ্ট হাতের মানুষটি ছিল আমাদের পপগুরু আজম খান।
যদিও তখন এবি, ম্যাক ভাই, মাইলসের গান বেশি শুনতাম, খুব বেশি আজম খান শুনতাম না। সত্যি বলতে ভাল লাগত না। কিন্ত মানুষটাকে ভাল লাগতো। কী যে মায়া তার পুরোটা জুড়ে।
সেই আজম ভাই আমাকে হাত ধরে উইন্টার গার্ডেনের দরজার সেকেন্ড চেক পয়েন্টে গিয়ে ওদেরকেও বলে দিল, যাতে আমার কোনো সমস্যা না হয়। আমি সোজা গ্রীনরুমে চলে গেলাম।
আগের দিনের কনসার্টে আমি , রোজ, মঞ্জুরা অধিকাংশ সময় গ্রীনরুমে রকস্টারদের সাথেই থাকতাম। ব্যাপারটা এমন যে, এই আয়োজনটা তো আমাদেরই। মাঝে মাঝে গ্রীন রুমের ভীড় ঠেলে অডিয়েন্সের সারিতে এসে ইভেন্ট দেখে আবার ঢুকছি। ঢুকছি আর বের হচ্ছি।
গ্রীনরুমের ভেতরে তখন মানাম ভাই, আইয়্বু বাচ্চু, মাকসুদ ভাই, শাফিন ভাই এবং গুরু আজম খানকে ঘিরে আড্ডা দিচ্ছে। দরজায় তাই কৌতুহলী তরুন তরুণীদের ভীড়। একটা অটোগ্রাফ পাবার আশায়। মোবাইল তখনও জন্মায়নি। তাই অধিকাংশের হাতে ছোট নোটবুক থাকতো। অটোগ্রাফ পাবার জন্য। আমাদের তখন ডাট ফাট দেখে কে!
সেই উঁকি দেয়া পছন্দনীয় কোনো তরুনীর হয়ত ডায়রী এনে আইয়ুব বাচ্চুর কাছে ওর নামে অটৈাগ্রাফ নিয়ে দিয়ে দিচ্ছি। বিশাল ব্যাপার।
মঞ্চে তখন ইভেন্ট চলছে। নানান স্বাদের গান বাজছে। আজ ফাইনাল ইভেন্ট।
আজম ভাই আমাকে ইশারায় বললেন,
‘খবরদার আমারে না বইলা যাবি না। তোরে আজ খাওয়ামু। ফাইভস্টারে খাইছস কোনদিন।
আমি বললাম
‘ না গুরু।’
চুপচাপ বইয়া থাক। শো শেষ কইরা আমাগো লগে যাবি। স্যালমন মাছ খাইছস কোনদিন?
আমি আবারও বলি – ‘না’
আজ খাওয়ামু তোরে.. আর সাথে জুস খাওয়ামু।
এদিকে তখন আমি কবির বকুল ভাইয়ের বাসাতে থাকি। বকুল ভাই বলে দিয়েছে ঘন্টা দুয়েক অবজার্ভ করে সন্ধ্যার পরপর বাসায় চলে আসতে। বেশি রাত যেন না করি। এসে লেখাটি রাতেই লিখতে হবে। পরদনই যাতে জমা দিয়ে দিই।
আমি সব ভুলে গেলাম আজম খানের প্রস্তাব পেয়ে। কিসের ঘরে ফেরা? ঘরটর , লেখালেখি পরে হবে। পুরো রাত থাকতে বললেও রাজী!
কনসার্ট শেষ হলো – এরপর আয়োজকদের নিয়ে বসলেন তারকারা।
আমাকে আজম ভাই তার পাশেই বসিয়ে রেখেছেন। বলে রাখা ভাল – তখন আমার সাইজ আর চেহারা দেখে অনেকেই হাইস্কুলের ছাত্র ভাবত!
এরপর শেরাটনের ডিনার রুমে রাত ১ টার দিকে আর্টিস্টরা খেতে বসবে। এক টেবিলে ম্যাক ভাই, হামিন ভাইসহ কজন। আরেক টেবিলে আজম খান আইয়ুব বাচ্চু , আমিসহ কজন।
বাচ্চু ভাই বললেন,‘আজম ভাই, পিচ্চিডারে রাখলেন এতরাত পর্যন্ত? ওরে বাসায় পাঠাইলেই পারতেন।
আজম ভাই বললেন,‘বাচ্চু তুমি কথা বলবা না। ওরে আমি আজ খাওয়ামু। এই ওরে স্যামন মাছ দে।
লাল লাল কী রঙা কয়েক স্লাইস মাছ এনে দিল। সারাদিনের খিদা পেটে ওটা মুখে দিতেই আমার বমি হবার জোগাড়।
আমাকে দেখে বাচ্চু ভাই , আজম ভাই দুজনাই মিটমিট করে হাসে! একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচায়ী করে।
আমি এরপর সেই বিস্বাদ স্যামন মাছ খুব ভাব মেরে টেস্টি ভেবে মুখে দিবার চেষ্টা করছি। ’
আজম ভাই বলল- আরে রাখ । তোর আর এক্টিং করতে হইব না। এই নে, এই জুস খাবি আর একটু মাছ খাবি।
দেখলাম। জুসের কালার সোনালি। আপেল জুস ভেবে মুখে দিতেই সে কী তেতা! আজম ভাই, বাচ্চু ভাই হো হো করে হেসে ওঠে।
বাচ্চু ভাই আবারও বলে, আজম ভাই হইসে। ওরে আমাদের একটা গাড়িতে কওে বাসায় পাঠায়ে দিই। ও আমাদের বকুলের বাসায় থাকে। জানেন তো?
- আরে জানি না মানে। ও তো আমার বাচ্চা।
আজম ভাই আবার ধমক লাগায় বাচ্চু ভাইকে।
তুই রাখ তো। ওকে সারাদিন বসায়ে রাখছি। ওরে আমি আজ খাওয়ামু। তানভীর তুই খা তো ব্যাটা। এই বলে, আমাকে ইশারা করলো –
নাক চিপপা ঢক ঢক কইরা এই জুস খাইতে হয়।
এরপর ডিনারের অন্যন্য স্যুপ, রাইচ, চিকেন সব খাইতে লাগলাম। সাথে আজম ভাইয়ের জুস।
তিন গ্লাস খাওয়া শেষ। আজম ভাই আমাকে সেসময় ৪র্থ গ্লাস দিতে বলবে ওয়েটারকে। ঠিক তখনই বাচ্চু ভাই বললেন,‘ না আজম ভাই। আমার বাচ্চাডারে আর দিয়েন না। ও বসুক। আমরা ফেরার পথে ওরে নামায়ে দিবো।
আমি ঝিম মেরে বসে আছি। পপগুরুর জুস খেয়ে। কিছুক্ষণ পর পর গুরু আমাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করেন।
রাত সাড়ে তিনটাই আমাকে বকুল ভাইয়ের দিলু রোডের বাসাতে রেখে গেল সবাই। আমি সিঁড়ি বাইতে পারছি না। দরজা খুললো বকুল ভাই নিজে। আমার জুসের স্মেল শুনেই বুঝে গেলেন তিনি। শুধু বললেন, কাল সকালে তোমার বাবার সাথে আমার কথা বলতে হবে। তোমাকে আর ঢাকায় রাখা যাবে না মনে হয়। আমি ভয়ে কাচুমাচু। কারণ আমার বাবার সাথে তখন বকুল ভাই রেগুলার কথা বলে। এদিকে সেই ভোররাতে সোজা বাথরুমে যেয়ে বেহুশের মতো বমি!!
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বকুল ভাই ভীষণ রাগ হয়ে বসে আছে। কারণ রাতে বেহুশ ছিলাম। কী লিখব কিছুই মাথায় নেই!
সকালেও লেখা দিতে পারবো না। কারণ গ্র্যান্ড ফিনালেতে কী কী হইসে কিছুই মাথায় নেই। মাথাভর্তি স্যালমন মাছ আর সোনালি জুস! তাই অন্যের কাছ থেকে নোট নিয়ে লিখতে হবে। এদিকে আব্বুর সাথে কথা বললে তো আমি শেষ!
বকুল ভাইয়ের কাছ থেকেই জানতে পারলাম সেই জুস আসলে ৫% অ্যালকোহল মেশানো পাণীয়। যাকে বিয়ার বলা হয়! এসব খাওয়া ঠিক না।
আমি বকুল ভাইকে বললাম , আমার কোনো দোষ নাই। সব দোষ আজম ভাইয়ের। উনিই আমাকে..
বকুল ভাই চুপ থেকে বেরিয়ে গেলেন। বললেন আজকের ভেতরে লেখা চাই। বাকি আলাপ অফিসে হবে। জলদি অফিসে এসো। আমি আজম ভাইকে টেলিফোনে কানেক্ট করার ট্রাই করলাম।
ক’দিন পর নিজেই কমলাপুর মাঠে গিয়ে পাকড়াও করলাম। ঘটনা খুলে বলতেই আজম ভাই বললো – আরে তোর বাপরে ফোন লাগা। আমি কথা কমু।
আমাকে ফুচকা চানাচুর খাওয়ালেন সেই বিকেলে..
আজম খান। মানুষটা কী এক মায়াভরা দরদ নিয়ে আমাকে বাচ্চা বাচ্চা বলে ডাকতেন সেসময়। পরে তানভীর নাম ধরে ডাকা শুরু করেছিলেন। কী মায়ার হাত দিয়ে বারবার পিঠ চাপড়ে কথা বলতেন। যখনই বলতাম, ইন্টারভিউ নিতে আসবো কবে? তখনই ক্ষেপে যেতেন। ধুর ব্যাটা। ঐসব পত্রিকার কথা কইলে আসবি না। আড্ডা দিবি, খেলবি। শরীর মন ভাল থাকবে।
গুরু। আমাদের শরীর মন আজ ভাল নাই। কারণ এমন সাহসী, মুক্তিযোদ্ধা, লোভহীন, দরদভরা মানুষ কোথায় পাই বলেন আর? এদেশকে যা কিছু দিয়ে গেছেন। মানচিত্রে, গানে ..এরপরও কোনো কিছুর প্রত্যাশার গল্প আপনার মুখ থেকে কোনোদিন শুনিনি।
শেষ দিকে বলতেন, আরে এই দেশ গড়ছিই তো আমরা। আবার চামু কার কাছে। কী চামু?
আজম ভাই আমার কাছে তাই খুব কাছের এক বড় ভাই হারানোর সমান বেদনার গল্প!
লেখক : সঙ্গীত পরিচালক, উপস্থাপক ও সংবাদকর্মী
12 Comments
Denzel Quinn
5th Apr 2023 - 12:30 pmI truly appreciate your technique of writing a blog. I added it to my bookmark site list and will
zebra printer near hsr layout
25th Apr 2023 - 4:00 amThis was beautiful Admin. Thank you for your reflections.
essae pos machine
28th Apr 2023 - 9:22 amI appreciate you sharing this blog post. Thanks Again. Cool.
React courses
30th Apr 2023 - 11:11 amI am truly thankful to the owner of this web site who has shared this fantastic piece of writing at at this place.
Jewelry design courses
1st May 2023 - 8:19 amYou’re so awesome! I don’t believe I have read a single thing like that before. So great to find someone with some original thoughts on this topic. Really.. thank you for starting this up. This website is something that is needed on the internet, someone with a little originality!
billing machine for cafe
5th May 2023 - 1:51 amThis is my first time pay a quick visit at here and i am really happy to read everthing at one place
free fifa points fifa 23
7th May 2023 - 5:31 pmFIFA POINTS FIFA 23 FREE CODE
digital scale
9th May 2023 - 2:13 amnaturally like your web site however you need to take a look at the spelling on several of your posts. A number of them are rife with spelling problems and I find it very bothersome to tell the truth on the other hand I will surely come again again.
barcode printing machine
10th May 2023 - 5:00 amI like the efforts you have put in this, regards for all the great content.
Patrick Roach
12th May 2023 - 2:02 pmI had a great experience shopping on istore.airriseinc.com! The website is user-friendly and the product selection is fantastic. https://istore.airriseinc.com/
tsc barcode printer
15th May 2023 - 2:04 amGreat information shared.. really enjoyed reading this post thank you author for sharing this post .. appreciated
Shea Watts
16th May 2023 - 11:48 amI do not even understand how I ended up here, but I assumed this publish used to be great