আমার বুকের দেশে ‘বাবা’ নামে এক হাহাকারের শহর আছে!
- November 22, 2020
- by
- tanvirtareq
তানভীর তারেক
কৈশরের প্রথমভাগ। আমি আমার প্রিয় মফস্বল ঈশ্বরদী ছেড়ে চলে যাচ্ছি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার গাজীপুর নামের দূর গাঁয়ে। একবুক বিষাদ নিয়ে চলছে ঈশ্বরদী টু খুলনার সীমান্ত এক্সপ্রেস। বাইরের দৃশ্যে তরতর করে চলে যাওয়া গাছ গাছালি আর ঈশ্বরদী থেকে দুরত্ব বাড়ার দৃশ্যে নামছে আমার বুকে একদলা হাহাকার। আমি প্রথম জীবনে কোনো এক বিচ্ছেদ বেদনায় কাঁদতে থাকি।
‘বিচ্ছেদ’ কী জিনিষ সেদিন প্রথম বুঝি। অনেকক্ষণ পর আমার মা আমাকে আবিস্কার করেন, আমি জানালায় দুহাতে থুতনি ডুবিয়ে অঝোরে কাঁদছি। সেই বেদনার ভিলেন ছিল আমার বাবা। কারণ বাবার ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছিল। ঈশ্বরদীতে বুকস্টল আর পত্রিকার এজেন্সী সহসব ব্যবসায় একে একে মামলা মোকদ্দমায় শত্রুর কাছে পরাজিত বাবা তার সংসার নিয়ে দূর গাঁয়ে যাচ্ছিলেন বাধ্য হয়ে। অথচ ঈশ্বরদীতে আমার ততদিনে নানারকম শেকড় তৈরি হয়েছে। প্রতিরোজ শেরশাহ রোডে খেলার সাথী, বন্ধু, আড্ডা, স্কুল পালিয়ে প্লাজা হলে সিনেমা দেখা সব কারবার চলছে হরদম। আমার নিজের এক রাজ্য তৈরি হয়েছে ঈশ্বরদীতে। সেই শেকড়গুলো উপড়ে ফেললো আমার বাবা। আমার জীবনের প্রথম ভিলেন! মনে আছে ট্রেনে বাবা তার ভীষণ অভাবের ভেতরেও যা যা খাবার পাওয়া যায় কিনলেন।
আমাকে তার নিজের করবেন বলে। তবুও বাবার দিকে তাকালাম না। রাগ। অভিমান। মায়ের পায়ে শুয়ে থাকলাম ট্রেনে। আমাকে আমার শহর থেকে উপড়ে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে সে অজপাড়াগাঁয়। কী ভীষণ খারাপ মানুষটা!সেই ভান্ডারিয়ার দূর গ্রামে তখন সবে ইলেকট্রিসিটি এসেছে। পল্লী বিদ্যুৎ। বাবার হাতে টাকা নাই। ভীষণ অর্থকষ্ট। বিদ্যুতের সংযোগ করলেন। আরো কত কী..তখন বুঝলাম, শহর থেকে হেরে যাওয়া নিরুপায় মানুষ গ্রামে ফিরে যায়! এখন যেমন ফিরে যাচ্ছে অনেকেই..!গ্রামে গিয়ে বাবা টিভি কিনলেন, আমার জন্য বড় এক ক্যাসেট প্লেয়ার কিনলেন। আমাকে নিয়ে গিয়ে কার কার গান পছন্দ সেই ক্যাসেট কিনলেন। আমি রহস্য পত্রিকা পছন্দ করি- সেটার ডাক যোগে গ্রাহক করলেন।
আমাকে ভোলানোর জন্য; তার যে কী চেষ্টা!অথচ বাবার জীবনে তখন সবচেয়ে অনটন। পরে শুনে বুঝেছি তার অভাবের মাত্রা তখন কতছিল! কল্পনাতীত।অথচ মজিবর নামে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ধারকর্য করে এসব কিনেছিলেন। মা আমাকে এসব সাংসারিক ব্যাপার বোঝাতে এলেন তখন। আমি কী আর বুঝি?আমি তখন শুধু জানি- বাবা একটা ভিলেন! আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে! কোনো বন্ধু নাই। আড্ডা নাই!আমি দুপুরে প্রায় ফুল ভলিউমে আইয়ুব বাচ্চু, মাকসুদের গান শুনি। বাবা অন্য সময় হলে তেড়ে আসতেন। বাবা ঘরে ঢোকার পরেই মা আমাকে ফিসফিসিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করতে বলেন, যাতে বাবা রাগ না করে। কীসের কী? আমি আরো সাউন্ড বাড়াতাম। মা অবাক! আমার আচরণে না! বাবার কান্ডে! কারণ বাবাটা আমায় কিছুই বলেন না! অথচ বাবার অর্থাভাব সেসময় কল্পনাতীত । নতুন কাজ খুঁজছেন। সম্পুর্ন নতুনজীবন!
কিন্তু বাজার থেকে যথাসম্ভব ভালোমন্দ যা পছন্দ করি তাই কিনলেন। তবু যাতে সন্তানের মন গলে। আমি গ্রামের বাড়িতে যেখানে যেখানে বসি। আমার পড়ার টেবিল । বৈঠকখানার সোফার পাশের দেয়াল। সব জায়গায় একটা দোয়া লিখে সেঁটে দেয়া থাকতো কাগজে। বাবার হাতের লেখা অসম্ভব সুন্দর ছিল। সেই হাতে বাংলা হরফে লেখা রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। সব জায়গায় এটা লিখে রেখেছো কেন?বললেন, তারিফ [ আমার ডাকনাম] তুমি যাতে ভুল করে হলেও এই লেখাটা দেখে পড়ে ফেলো। আমি মারা যাবার পর তোমার এই একটা দোয়াই আমার কাজে লাগবে। আর কিচ্ছু কাজে লাগবে না। বাবা মারা যাবে? কেন? বাবা এমন ভাবে বললেন, ভীষণ ধাক্কা লাগল! এরপর অনেকগুলো বিকেল আমি আর আমার একমাত্র বোন মেরীকে দুই পায়ের ওপরে শুইয়ে বাবার কাটানো ঢাকার বাংলাবাজারের ব্যচেলর দিনগুলোর গল্প শোনাতেন।
৭১ এ হানাদার বাহিনীর মার খেয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবার গল্প শুনতাম। ..আমাদের দুই ভাইবোন যাতে মন খারাপ না করে থাকে। সে কী চেষ্টা মানুষটার! জীবনে কঠিন দারিদ্রের দিনে সবকষ্ট ঢাকার চেষ্টায় আসলে তিনি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিলেন ক্রমশ। বাবা এরপর প্রায় ৫ মাস বেকার ছিলেন। দিগি¦দিক হয়ে গিয়েছিলেন । কিছুই বুঝতে দিতেন না। সেসময় অভাব কাকে বলে তখন যতটুকু বুঝেছি! তারচেয়ে এখন বুঝতে পারি, কী সয়েছিল আমার ভিলেন থাকা বাবা নামের মানুষটা। হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা বাবাকে আমি কাঁদতে দেখেছিলাম। সে দৃশ্য আমি জীবনেও ভুলবো না। আমাকে দেখে চোখ সরিয়ে ফেলেছিলেন। আজ এসব দৃশ্য চিন্তা করলে এলোমেলো লাগে আমার। মনে হয়, বাবাকে কবর থেকে তুলে নিয়ে আরেকবার জড়িয়ে ধরে থাকি অনেকক্ষণ। আজ এসব ভাবলে চোখ ভারী হয়ে আসে! খ্বুব। খুউব!বাবারা এমনই। দুঃখের পাহাড় পুষে- শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মতো হাজির হন তার সন্তানের কাছে। জীবন সংসার তখন তার কাছে হাউজফুল কোনো এক মঞ্চ। বাবারা নিখুঁত অভিনয় করে চলেন! বাবারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা।
তাতাপোলব্ধি।
বাবা চলে যাবার ১ যুগ পরের কোনো এক বাবা দিবসে। ২০২০